Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

Image
Title
প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব
Details

প্রখ্যাত রসায়নবিদ বিজ্ঞানী পি,সি,রায়: বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী রসায়নবিদ স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (পি,সি,রায়)। এই অমর বিজ্ঞানী খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী রাড়ুলী গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্ম গৌরবে শুধু তার জন্মভূমি দক্ষিণ খুলনার অবহেলিত জনপদ পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী গ্রামই ধন্য হয়নি বরং সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষ তার জন্ম গৌরবে গৌরবান্বিত। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে “আমি বৈজ্ঞানিকের দলে বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম সেবকদের সাথে গ্রাম সেবক, আর অর্থনীতিবিদদের মহলে অর্থনীতিজ্ঞ।” রসায়ন শাস্ত্রে অসামান্য অবদানের জন্য আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় দুনিয়া জুড়ে পরিচিত হন।

পিতা আরবী, ফার্সী ও ইংরেজী ভাষায় দক্ষ জমিদার হরিশ্চন্দ্র রায়। মাতা ভূমন মোহিনী দেবী একজন গৃহিনী। পিতা-মাতার আদরের সন্তানটি হলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। পিতা তাকে ডাকতেন ফুলু বলে। ছোটবেলায় মায়ের নিকট শিক্ষার হাতেখড়ি। ফুলুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়স থেকে। এরপর পাঠশালা এবং পরে পিতার প্রতিষ্ঠিত এম.ই. স্কুলে ৯ বছর পর্যন্ত লেখাপড়া করে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে কোলকাতায় চলে যান। ১৮৭২ সালে কোলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৭৪ সালে ৪র্থ শ্রেনীতে পড়ার সময় গুরুতর রক্ত-আমাশয়ে আক্রান্ত হওয়ায় ২ বছর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। এই পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাওয়া তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে উঠে। এই সময় পিতা হরিশ চন্দ্র রায়ের লাইব্রেরীতে পড়াশুনা করে পৃথিবীর জ্ঞান ভান্ডারের সন্ধান পান। ১৮৭৬ সালে কেশব চন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ‘আলবার্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৭৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগ পেয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বৃত্তি না পাওয়ায় তার শিক্ষকরা নিরাশ হলেও তিনি মনে করতেন “পরীক্ষার নম্বরই মানুষের জীবনের শেষ কথা নয়”, যারা পরীক্ষায় ভালো করেছে তারা অনেকেই পরবর্তী জীবনে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। জীবনের ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য স্থির লক্ষ্য ও সুষ্ঠুভাবে অধ্যাবসায়ের সঙ্গে শিক্ষালাভ অনেক বেশী ফলপ্রদ।

১৮৮০ সালে মেট্রোপলিটন (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে ২য় বিভাগে এফ.এ. পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এ. ভর্তি হন। ১৮৮২ সালে তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি লাভ করে লন্ডন চলে যান এবং এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এস.সি তে ভর্তি হন। ১৮৮৫ সালে ঐ কলেজে পড়ার সময় ‘সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে’ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে Essay on India নামে প্রবন্ধটি বই আকারে প্রকাশিত হয়।

এডিনবার্গ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি.এস.সি পাশ করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য গবেষনা শুরু করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিলো “অন পিরিয়ডিক ক্লাসিফিকেশন অফ এলিমেন্টস”। ১৮৮৭ সালে তিনি সফলতার সাথে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষনা পত্রটি শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হওয়ায় তাকে ১০০ পাউন্ড ‘হোপ প্রাইজ’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার পরও তিনি আরও এক বছর “অন এ্যানালিসিস অফ ডাবল সালফেটস এন্ড দেয়ার কৃস্টাল বিহেভিয়ার” বিষয়ে সেখানেই গবেষনা করেন।

পড়াশুনা শেষ করে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় দেশে ফিরে আসেন এবং প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ এ এবং পরবর্তীতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজে পালিত অধ্যাপক এবং ১৯৩৭ সাল থেকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমৃত্যু (Emiritius Professor) এমিরিটাস প্রফেসর হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।

শিক্ষক হিসেবে পড়ানোর সময় উদ্দীপক উপাক্ষান বর্ণনার মত করে সাহিত্যের প্রাঞ্জল ভাষায় রসায়নের বিষয়গুলি তিনি ছাত্রদের নিকট তুলে ধরতেন। আত্মচরিত তিনি বলেছেন “ প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার ২৭ বছর অধ্যাপনা জীবনে আমি সচেতনভাবে প্রধানত: নিচের ক্লাসেই পড়াতাম। কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পচ্ছন্দমত আকার দিতে পারে হাই স্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমনি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়। আমি কখনও কোন নির্বাচিত পাঠ্যবই অনুসরন করে পাঠদান দিতাম না”। শিক্ষক হিসেবে তিনি বলতেন “ সর্বত্র জয় অনুসন্ধান করিবে কিন্ত পুত্র ও শিষ্যের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া সুখী হইবে।

একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে কতটুকু ভালোবাসেন বা দিকনির্দেশনা দেন তার প্রমান পাওয়া যায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কর্মকান্ডে। ফজলুল হক (শের-এ বাংলা) ৫/৬ দিন ক্লাসে না আসলে একদিন বিকালে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার বাসায় যান। ফজলুল হক তখনও খেলার মাঠে থাকায় তিনি তার জন্য অপেক্ষা করেন। ফজলুল হক ফিরে এসে স্যারকে দেখে তিনি কতক্ষন এসেছেন জানতে চাইলে বলেন “তোমাদের হিসেবে এক ঘন্টা আর আমার হিসেবে ষাট মিনিট”।

শিক্ষক হিসেবে স্যার পিসি রায়ের নিরপেক্ষতা ও ধর্ম বিষয়ে উদারতার প্রমান পাওয়া যায়। ১৯১৫ সালে কুদরত-ই খুদা (একমাত্র মুসলিম ছাত্র) এম.এস.সি তে (রসায়ন) প্রথম শ্রেনী পাওয়ায় কয়েকজন হিন্দু শিক্ষক তাকে অনুরোধ করেন প্রথম শ্রেণী না দেওয়ার জন্য, কিন্ত আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রাজী না হওয়ায় তারা প্রস্তাব দেন একজন হিন্দু ছেলেকে ব্রাকেটে প্রথম শ্রেণী দেয়ার জন্য, তিনি সে প্রস্তাবেও সম্মত হন নি।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একই প্রতিষ্ঠানের, একই সময়কার শিক্ষক ও বিজ্ঞানী ছিলেন। কিন্ত স্যার পি.সি রায়ের ছাত্ররাই পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, সে কারনেই স্যার পি.সি. রায়কে “বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী” বলা হত। তার কৃতি ছাত্রদের মধ্যে শের-এ বাংলা এ,কে ফজলুল হক, ড: মেঘনাথ সাহা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমান বিহারী দে, ড: কুদরত-ই-খুদা, প্রিয়দা ভন্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়, জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপদ্যায়, রাজেন্দ্র লাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জী প্রমূখ।

১৯১২ সালে লন্ডনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ড: প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে পাঠান। এই সময় ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় পি.সি. রায়কে সম্মান সূচক ‘ডক্টরেট’ উপাধি প্রদান করেন। এছাড়া তিনি কলিকাতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

তার গবেষনা পত্রের জন্য স্যার উইলিয়াম রামসে তাকে অভিনন্দন জানান। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড: এইচ. ভেলি স্বাগত জানিয়ে বলেন, “তিনি (অধ্যাপক রায়) সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা প্রতিনিধি- যে জাতি সভ্যতার উচ্চস্তরে আরোহণ করত: এমন এক যুগে বহু রাসায়নিক সত্যের আবিস্কার করিয়াছিলেন, যখন এদেশ (ইংল্যান্ড) অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। অধ্যাপক রায় এ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট সম্মন্ধে যে সত্য প্রমান করিয়াছেন তাহা প্রচলিত মতবাদের বিরোধী।” একই বছর স্যার পি.সি রায় ব্রিটিশ সরকার কতৃক Companion of the Indian Empire(C.I.E.) উপাধিতে ভূষিত হন এবং ১৯১৯ সালে “নাইট” উপাধি দিয়ে ব্রিটিশ সরকার তাকে সম্মানিত করেন। ১৯৩২ সালে স্যার পি.সি রায়ের সত্তরতম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর। সভাপতির ভাষনে কবিগুরু বলেন ‘আমরা দুজনে সহযাত্রী, কালের তরীতে আমরা প্রায় একঘাটে এসে পৌছেছি। পরে কবিগুরু আচার্যদেবের হাতে একটি তম্রিফলক উপহার দেন। কবির স্বরোচিত দুটি ছত্র তাতে উৎকীর্ণ ছিলো-

‘প্রেম রসায়নে ওগো সর্বজনপ্রিয়
করিলে বিশ্বের জনে আপন আত্মীয়।’

১৮৮৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রিলাভের পর বিজ্ঞানের গবেষনায় স্যার পি.সি. রায়ের যে যাত্রা শুরু হয়েছিলো, ১৮৯৫ সালে মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিস্কারের ফলে সফল বিজ্ঞানী হিসেবে তার স্বীকৃতি মেলে। এরপরে ১২ টি যৌগিক লবন ও ৫ টি থায়োষ্টার আবিস্কার এবং ১৪৫ টি গবেষনা পত্র প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ডাচ একাডেমী লন্ডনের রসায়ন সমিতি তাকে অনারারী ফেলো নির্বাচিত করেন।

হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস লিখে স্যার পি.সি. রায় ১২০০ শতাব্দী এবং তারও পূর্বের ভারতবর্ষের রসায়ন চর্চার ইতিহাস তুলে ধরে প্রমান করেন, যখন ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ গাছের ছাল বা বাকল পরে লজ্জা নিবারণ করতো, তখন ভারতবর্ষের মানুষ পারদের ব্যবহার এবং সাতন পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত ছিলো।
স্যার পি.সি. রায় ১৮৯২ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল এ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেন যা পরর্তীতে “বেঙ্গল কেমিকেল এ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কাস লি:” নামে ১৯০১ সালের ১২ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে নিজ জেলা খুলনার মানুষের কমর্সংস্থানের কথা চিন্তা করে সমবায় ভিত্তিক “প্রফুল্ল চন্দ্র কটন টেক্সটাইল মিলস লি:” প্রতিষ্টা করেন।

১৯০১ সালের ডিসেম্বরে গান্ধীজি মহামতি গোখলের সাথে কলিকাতায় আসলে, তিনি তার সাথে স্যার পি.সি. রায়ের পরিচয় করিয়ে দেন। গান্ধীজির মুখে প্রবাসী ভারতীয়দের দু:খ-দুর্দশার কথা শুনে কলিকাতাবাসীদের এ বিষয়ে জানানোর জন্য ১৯০২ সালের ১৯ জানুয়ারী কলিকাতার আর্লবাট হলে (বর্তমান কফি হাউজ) এক সভার ব্যবস্থা করেন। তখনকার দিনে এই সভা এতই সফল হয়েছিলো কলিকাতার সকল সংবাদপত্র এ বিষয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গান্ধীজির অনাড়ম্বরপূর্ন জীবন ও মানুষের জন্য তার মমত্ববোধ স্যার পি.সি. রায়ের জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলো বলেই তিনি নিজেকে কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন।

বৃটিশ গোয়েন্দা দপ্তরে স্যার পি.সি. রায়ের নাম লেখা ছিল “বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী”। ১৯১৯ সালে ১৮ জানুয়ারী রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে টাউন হলে চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে এক সভা হয়। স্যার পি.সি.রায় সেখানে যোগ দিয়ে বলেন ‘আমি বৈজ্ঞানিক, গবেষণাগারেই আমার কাজ, কিন্ত এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও দেশের আহবানে সাড়া দিতে হয়। আমি অনিষ্টকর এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করছি।

১৯২৫ সালের জুনে বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার তালার সৈয়দ জালাল উদ্দীন হাসেমী ও ডুমুরিয়ার মাওলানা আহম্মদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন প্রচারে গান্ধীজি খুলনায় আসলে স্যার পি.সি. রায় স্টিমার ঘাঠে তাদের স্বাগত জানান। স্যার পি.সি.রায় ছিলেন সম্বর্ধন কমিটির সভাপতি। ১৯২৫ সালে কোকনাদ কংগ্রেসের কনফারেন্সে সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ আলীর অনুপস্থিতে কিছু সময় স্যার পি.সি. রায় সভাপতিত্ব করেন। একই সময় পাইকগাছা উপজেলার কাটিপাড়ায় “ভারত শেবাশ্রেম” নামে একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে নিজ জন্মভূমির এলাকার মানুষকে চরকায় সুতো কাঠার মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। বিজ্ঞান কলেজের বারান্দায় একটা চরকা স্থাপন করে তিনি নিজেও সুতা কাটতেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের লবন আইন অমান্য আন্দোলনের খুলনা জেলার স্থান হিসেবে স্যার পি.সি. রায়ের নিজের গ্রাম রাড়ুলিকে নির্বাচন করেন।

১৯০৩ সালে পিতার প্রতিষ্ঠিত এম.ই স্কুলকে উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত করেন এবং তিনি ও তার ভাই নলিনী কান্ত রায় চৌধুরী -রাড়ুলী, বাকা, কাটিপাড়া, খেসরা প্রভৃতি গ্রামের বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিদের এক সভা থেকে আর.কে.বি.কে. হরিশচন্দ্র ইনষ্টিটিউট নাম করন করেন। একই স্থানে স্যার পিসি রায়ের পিতা উপমহাদেশে নারী শিক্ষা উন্নয়নকল্পে ভূবনমোহিনীর নামে ১৮৫০ সালে রাড়–লী গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯১৮ সালে বাগেরহাটে তার অর্থানুকূল্যে বাগেরহাট কলেজ স্থাপিত হয় যা পরে স্যার পি.সি. রায়ের আপত্তি সত্বেও তারই ছাত্র শের-এ-বাংলা ফজলুল হকের প্রস্তাবে পি.সি. কলেজ নামে পরিচিতি পায়। এছাড়া সাতক্ষীরা চম্পাপুল স্কুলও স্যার পি.সি. রায়ের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।

উল্লেখ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পিসি রায় ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা দান করেন। খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ, বরিশালে অশ্বর্ণী কুমার ইনষ্টিটিউশন, যাদবপুর হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল সহ প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে তিনি অর্থনৈতিক অনুদান দিয়েছেন। দেশ বিদেশে তার স্থাপিত প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞান সাধনায় স্মরণ করছে সর্বস্তরের মানুষ।

স্যার পি.সি.রায় বাঙালী জাতিচেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং দেশের সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তদানিন্তন সময়ে পল্লী মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায় ব্যাংক পদ্ধতি চালু করেন। ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমিতে কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯২৩ সালে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ধর্মগোলা ও সমবায় ভান্ডার স্থাপনের পরামর্শ দেন। ১৯১৭ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল সমবায় সমিতি, ১৯১৮ সালে বঙ্গবাসী কলেজ কো-অপারেটিভ ষ্টোর এন্ড কেন্টিন, ১৯২১ বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটি সহ অনেক সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।

আজও প্রতিষ্ঠানগুলো স্বমহিমায় এগিয়ে চলছে। দেশ-বিদেশে তার স্থাপিত প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞান সাধনায় ফলক স্মরণ করে সর্বস্তরের মানুষ। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অবিবাহিত। ১৯৪৪ সালে ১৬ জুন কোন উত্তরসূরী না রেখে জীবনাবসান ঘটে বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। শেষ জীবনে তার স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছিলো, স্পষ্ট করে কথা বলতে পারতেন না, এমন কি নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে পারতেন না। তার মৃত্যুর খবর পেয়েই শের-এ-বাংলা ফজলুল হক, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন, শিক্ষামন্ত্রী নাজিম উদ্দীন খান, সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ও অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা ছুটে যান শেষ বারের মত এই মহান মানুষকে দেখার জন্য।

মৃত্যুর ৬৮ বছর পর ব্রিটেনের বিরল সম্মানে ভূষিত হলেন বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (পি.সি রায়)। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের এক অনুষ্ঠানে ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিষ্ট্রির (আরএসসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রবার্ট পার্কার জানান, তাঁরা বাঙ্গালী বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে “কেমিক্যাল ল্যান্ড মার্ক প্লাক” দিয়ে বিশেষ সম্মাননা জানাবেন। এ খবর পেয়ে বিজ্ঞানীর জন্মস্থান পাইকগাছা, খুলনাসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়েছিল। রসায়ন গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃিত হিসেবে আরএসসি “কেমিক্যাল ল্যান্ড মার্ক প্লার্ক” দিয়ে থাকে। বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কারক। এই আবিস্কারের জন্য আরএসসি তাঁকে এ বিরল সম্মাননা জানান।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যের ধারক-বাহক কপোতাক্ষ তীরের কপিলমুনির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। শাহ সুফি হযরত জাফর আউলিয়া (রহ.), মুনি কপিলেশ্বর এবং রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর স্মৃতিবিজড়িত কপিলমুনির অনেক ইতিহাস এখন কিংবদন্তি। অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে গেছে অনেক ঐতিহাসিক স্থানের চিহ্ন। অবৈধ দখলের কারণে আধুনিক কপিলমুনির রূপকার রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বিনোদ ভবন ও বৈঠকখানা এখন জরাজীর্ণ। জীর্ণ ভবনে চলছে ১০ শয্যার ভরতচন্দ্র হাসপাতাল ও সিদ্ধেশ্বরী ব্যাংকটি (বর্তমানে বণিক সমিতির অফিস) নিশ্চিহ্ন হয়েছে সরোবর ও পাবলিক স্টেডিয়ামটি। আজও নির্মিত হয়নি বিনোদ বাবুর জীবদ্দশার স্বপ্ন কানাইদিয়া কপিলমুনি যোগাযোগের মাধ্যম ব্রিজটি। কপিলমুনিকে-কপোতাক্ষ সভ্যতার প্রচীনতম নিদর্শন বলে দাবি করেন অনেক ঐতিহাসিক। তাদের মতে বৃহত্তর খুলনার মধ্যে কপিলমুনিতে প্রথম হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়।
পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে রয়েছে হজরত খাজা খানজাহান আলী (রহ.) এর শিষ্য হজরত জাফর আউলিয়ার মাজার। খানজাহানের সঙ্গে এদেশে যে ৩১৬ জন দরবেশ ও আউলিয়ার আগমন ঘটে এরমধ্যে পীর জাফর আউলিয়া একজন। কপোতাক্ষ নদের তীর ধরে সুন্দরবন অঞ্চলে এসে ইসলাম প্রচারে ও সমাজসেবায় নিয়োজিত ছিলেন পীর জাফর আউলিয়া। তার মাজার রয়েছে কপিলমুনিতে। এ মাজার ঘিরে তার নামেই গড়ে ওঠেছে জাফর আউলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসা ও মসজিদ। মাজারসংলগ্ন একটি ছোট পুকুর আছে। অনেকেই রোগব্যাধি সারতে এ পুকুর থেকে পানি নিয়ে খেতেন। বর্তমানে সেখানে নোংরা পানি ফেলা হচ্ছে।
কপিলেশ্বর থেকে কপিলমুনি। এক হিন্দু মুনি কপিলের নামানুসারে এ এলাকার নামকরণ হয় কপিলমুনি এমন মত প্রচলিত আছে। ৬০ হাজার সাগর সন্তানকে শাপবদ্ধ করে চাড়ালে রূপান্তর করেন কপিলদেব। ঐতিহাসিকদের মতে, গৌড় দেশের পরাক্রমশালী রাজা বসুদেব পুত্র পার্থিব সম্পদের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে কপিলদেব সুন্দরবনাঞ্চলীয় কপোতাক্ষ তীরে এসে একটি বটতলায় আশ্রম তৈরি করে তপস্যা শুরু করেন। চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে তিনি এখানে তৈরি করেন একটি কালীমন্দির। তিনি তপস্যার জন্য যে স্থানে আশ্রম তৈরি করেন সে স্থান তারই নামানুসারে হয়েছে কপিলমুনি। এমন মত প্রচলিত রয়েছে। কালের গর্ভে কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে আশ্রম প্রাচীনতম স্মৃতিচিহ্ন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে ওই স্থানে বটবৃক্ষের চারা রোপণ করে স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার চেষ্টা চলছে।এ অঞ্চলটি একসময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত ছিল। ১৮৯৬ সালে রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ির কাছে একটি পুকুর খননকালে এখানে পাওয়া যায় বৌদ্ধ যুগের তিনটি পাথরের মূর্তি। মূতির সঙ্গে ছিল মোমের স্তূপ। ধারণা করা হয়, বৌদ্ধ বিহারে মোম জ্বালিয়ে এখানে উপাসনা করা হতো। কপিলমুনির কাশিমনগর (দম দম) গ্রামে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসবাসের স্মৃতিচিহ্ন আজও চোখে পড়ে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চাঁদ সওদাগরের মতো একাধিক সওদাগর গয়না নৌকা করে এ অঞ্চলে বাণিজ্য করতে আসতেন এবং কালক্রমে এখানে বসতি স্থাপন করেন। এ অঞ্চলে মাটি খুঁড়লে আজও পুরাকীর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। পুরাকীর্তি নিদর্শনসমৃদ্ধ এ অঞ্চলকে আজও সরকারিভাবে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মূল্যবান সম্পদ ও ঐতিহাসিক স্থানের স্মৃতিচিহ্ন। কপিলমুনির আরেক বিদগ্ধের নাম রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু। এলাকাবাসী তাকে আধুনিক কপিলমুনির রূপকার ও স্থপতি হিসেবে জানেন। কপিলমুনিজুড়েই তার স্মৃতি বিদ্যমান। ক্ষণজন্মা বিনোদ বিহারী সাধু ছিলেন একজন তেল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক জীবনের উত্থান-পতনের সময় তার উপদেষ্টা হিসেবে সাহায্য করেন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তার সমাজসেবামূলক কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে রায়সাহেব উপাধিতে ভূষিত করেন। এশিয়া মহাদেশে হিন্দু ধর্মের মূল চারটি ধর্মগ্রন্থের একটি বেদ এ মন্দিরে রক্ষিত আছে। অধিকাংশ শ্বেত পাথরে আবৃত এ মন্দিরটি। এ মন্দিরে আরও আছে শ্বেত পাথরের তৈরি রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর প্রতিকৃতি। বর্তমানে আধুনিক কপিলমুনির রূপকার বিনোদ বিহারী সাধু তৈরি করেন বিনোদগঞ্জ বাজার। তার নামানুসারে বাংলা ১৩৩৯ সনে এ বাজারের নামকরণ হয় বিনোদগঞ্জ। কালক্রমে এটি এখন কপিলমুনি হিসেবে পরিচিত। এটি জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম উপশহর।